হারানো মোজা

আমি তো শুধু একটা সাদামাটা মোজা — কিন্তু আমারও একটা জীবন আছে, বিশ্বাস করবে? নাম দিয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই সবাই: টিকটিকি (কারণ আমার ওপর ছোট ছোট টিকটিক রঙীন দাগ)। আমার কথা শুনলে তোমার ছুঁট করে হাসি উঠে যাবে, কিন্তু বাঁচতে বাঁচতে আমি অনেক গল্প সঞ্চয় করেছি।

আমি জন্মেছিলাম এক কলকারখানার উষ্ণ কুঁড়িতে — রেশমী সুতো আর মেশিনের গুঞ্জনে। প্রথম দিনেই আমাকে জোড়ার সঙ্গে গুটিয়ে দিলো — বন্ধু পায়ে লাগবে, আমি শক্ত সবল বোধ করিনি, শুধু কৌতূহল। তারপর একটি প্যাকেটে ঢোকা; রঙিন কাগজের ঝাপটা, দোকানের ঝলমলে তাক — সেটাই ছিলো আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা।

একদিন টানটান কাগজ কেটে আমাকে একজন বাচ্চা হাতে তুলে নিল। সে বলল, “মজা হবে!” — আর সত্যি, পায়ের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপটি ছিলো একেবারে মজার। সে দৌড়ালো, লাফালাফি করলো, কাদা খেলো — আমি পায়ে ছিলাম, আমার রেশটা ম্লান হলেও আত্মা জেগে উঠলো। বন্ধু মোজার সঙ্গে আমরা একসাথে ফুটবলের পাগलেমি সহ্য করেছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, সূর্যাস্তের পায়ে হেঁটেছি।

ওই কপি ছিলো — অবশ্যই, প্রতিটি সুখের পাশে একটু বিপদ আসে। একদিন লন্ড্রি যন্ত্রে ঢুকলাম; বুদ্বুদ আর চড়প্পে চক্রে আমরা ঘুরতে ঘুরতে বড়ো বনে পরিণত হলো। সেখানেই আমার এক জোড়া হারিয়ে গেলো। বাইরে বেরিয়ে দেখি — আমার সঙ্গী নেই! আমি খুঁজে বেড়ালাম: ধারে-পারে কাঁচের নিচে, সোফার মাঝে, বালিশের কেল্লায় — কিন্তু সে নাই। মনে হল যেনো পৃথিবীর সব শব্দ থেমে গেছে।

ও পর্যন্ত নিজেকে হারানো মনে করলাম না; বরং এক নতুন জীবন শুরু করলাম। আমি এক পায়ে, অদ্ভুত কৌতূহল ও গর্ব নিয়ে — কারণ আমি এখন অনন্য। মেয়ে-ছেলেরা আমাকে কখনো ভুলে যায়, কেউ কেউ আমাকে তাঁর পেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে, কোন একবার রাতের ঝাঁকুনিতে আমি শুয়ে পড়ি সোফার নিচে — সেখানে রাজা-রাজা দৃষ্টিতে আমি সবার গল্প শুনি।

বেশ কিছু দিন পরে, এক ছোট্ট বাচ্চা আমাকে পেলো — সে আমার ভেতর দিয়ে আঙুল घুসিয়ে হাসলো, আমাকে পুকুরে দিয়ে খেলালো। আমি ভাঙা সূর্যের মতো উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো ফিরে পেলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে ফাটলও আসলো; ছেঁড়া অংশে একটি ছোট কীট বাসা বসাল — আমি বুঝেছি, শরীর ম্লান হতে পারে, কিন্তু স্মৃতি টিকে থাকে।

এখন আমি আর নতুন-নতুন জোড়া চাই না। সকালে গরম চায়ের কাপের নিচে বসে আমি আরেকটি কাজ শিখেছি — নরম-শিষ্ঠ বস্তুর মধ্যে গরম রাখতে সাহায্য করা। কখনো কোনো দিন আমি গাছের নীচে বাগানের মালচ হয়ে যাই, আবার কখনো অনুপ্রাণিত লেখার জন্য টেবিলের কোণে ঝুলে থাকি — মনে করো না, মোজাও শিল্পীর শ্রেণীভুক্ত।

আমার জীবন যদি তুমি পড়ো, তুমি জানতে পারবে — হাসি, ছ্যাকা, হারানো এবং নতুন পাওয়ার মধ্যেই জীবনের আসল গতি থাকে। আর যদি কখনো তোমার মোজা মিল না খায়, ভেবে দিও: সে হয়তো কোনো জমকালো অভিযান নিয়ে বেরিয়েছে — আর আমি? আমি এখানেই আছি — একটু ছেঁড়া, একটু দাগি, কিন্তু পূর্ণ স্মৃতি-ভরা। শেষ কথা: যদি তুমি কখনো আমাকে পায়ে পরো, আমার ভাঙা অংশে তোমার গোপন খেলা ঢুকিয়ে দাও — আমিই তোমার নীরব সাহচর্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top