🏙️ শহরের রাত

ঢাকার ব্যস্ত শহর দিনে যেমন কোলাহলমুখর, রাতে যেন একেবারে অন্য রূপ ধারণ করে। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা ফাঁকা, কেবল ছুটে চলে কিছু গাড়ি আর দূর থেকে ভেসে আসে হর্নের শব্দ। কিন্তু শহরের রাত মানেই সবার বিশ্রাম নয়—অনেকের জন্য রাত মানে সংগ্রাম।

কাশেম একজন রিকশাওয়ালা। সারাদিন রোদে-গরমে রিকশা চালিয়ে যখন রাত নামে, তখনো তাকে খেটে যেতে হয়। কারও অফিস থেকে ফেরা, কারও বাজারের ব্যাগ—সবই তার রিকশায়। শহরের আলো-ঝলমলে রাস্তাগুলোতে সে ছুটে চলে ক্লান্ত শরীরে। কখনো যাত্রী ভাড়া কম দেয়, কখনো ঝগড়াও করে, তবুও কাশেম চুপচাপ মেনে নেয়। কারণ তার মনে একটাই চিন্তা—আজ কিছু টাকা রোজগার হলে মেয়ের স্কুল ফি দেওয়া যাবে।

রাত যত গভীর হয়, কাশেমের শরীর তত ভারী লাগে। হাত-পা ব্যথায় ভরে ওঠে, পিঠে টান ধরে। তবুও সে হাল ছাড়ে না। মনের ভেতরে ভেসে ওঠে ছোট্ট মেয়ের মুখ। মেয়েটা প্রতিদিন দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে—“বাবা, তুমি আসবে কবে?” সেই ডাকে কাশেমের সব কষ্ট ভুলে যায়।

সেদিন রাত তখন প্রায় এগারোটা। বৃষ্টি নামল টুপটাপ করে। রাস্তায় যাত্রী নেই বললেই চলে। ভিজে শরীর নিয়ে কাশেম ক্লান্ত হয়ে রিকশা দাঁড় করাল। কিন্তু চোখে ভেসে উঠল মায়ের মতো মুখভরা হাসি নিয়ে মেয়ের ছবি। “না, আরেকটু চালাতে হবে,” মনে মনে বলল সে। কারণ জানে, ঘরে খালি হাতে ফিরলে মেয়ের চোখে হতাশা ফুটে উঠবে।

অবশেষে রাত সাড়ে বারোটার দিকে সে বাড়ি ফিরল। পুরনো ভাঙাচোরা ভাড়া বাসা, তবে সেখানে লুকিয়ে আছে তার সব ভালোবাসা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার মেয়ে। ভিজে কাপড় দেখে মেয়েটা বলল—
“বাবা, তুমি ভিজেছ কেন? অসুস্থ হয়ে যাবে তো।”

কাশেম হেসে উত্তর দিল—
“না মা, আমি শক্ত। তুই শুধু ভালো করে পড়াশোনা করিস, তাহলেই বাবার সব কষ্ট সার্থক হবে।”

মেয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখের ভেতরে যেন নতুন আলো জ্বলে উঠল। ক্লান্ত শরীরেও সেই ভালোবাসা কাশেমকে নতুন শক্তি দিল।

বাইরে তখনও শহরের আলো ঝলমল করছে। রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির হেডলাইটে অন্ধকার কাটছে। কাশেমের মনে হলো—এই শহরের রাত যত অন্ধকারই হোক না কেন, মেয়ের হাসিই তার জীবনের আসল আলো।

---

✨ শিক্ষা:

শহরের রাত শুধু কোলাহল বা নীরবতার গল্প নয়; এটি পরিশ্রম, ত্যাগ আর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। যাদের ঘাম ঝরে রাস্তায়, তারাই আসলে শহরকে বাঁচিয়ে রাখে। আর পরিবারের হাসি-আনন্দই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।